নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য সম্পদ

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - NCTB BOOK

15.1 সম্পদ

সম্পদ বলতে আমরা কী বোঝাই? প্রাণ ধারণ থেকে শুরু করে উন্নত জীবন যাপনের জন্য যা কিছু মানুষের প্রয়োজন তার সবই সম্পদ। সে কারণে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধি, দক্ষতা-অভিজ্ঞতা সেগুলোও সম্পদ, সেজন্য দক্ষ মানুষকে আমরা মানব সম্পদ বলি। তবে এই অধ্যায়ে আমরা মানব সম্পদ নয়, শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে আলোচনা করব।

লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুর মতো পানি, বায়ু, সূর্যের আলো, মাটি সব আমরা প্রকৃতি থেকে পাই, তাই এই সবই প্রাকৃতিক সম্পদ। আমরা শক্তির উৎস হিসেবে কাঠ, গ্যাস, কয়লা এরকম বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করি। আবার বিভিন্ন বস্তু তৈরিতেও নানান সম্পদ ব্যবহার করা হয়। যেমন- বিভিন্ন প্রকার গাড়ির কাঠামো এবং যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করতে যে ধাতু লাগে তা খনি থেকে সংগ্রহ করা আকরিক থেকে নিষ্কাশন করে পাওয়া যায়। গাড়ির চাকা যে রাবার থেকে তৈরি হয় তা আসে রাবার গাছ থেকে সংগ্রহ করা আঠা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে। যে পেন্সিল দিয়ে আমরা লিখি বা আঁকি তার কাঠ আসে সিডার বা পপলার গাছ থেকে। পেন্সিলের শিস তৈরির অন্যতম উপাদান গ্রাফাইট (যা এক ধরনের কার্বন) সংগ্রহ করা হয় খনি থেকে। যে পানিতে আমরা কাপড় পরিষ্কার করি এবং যে সূর্যের আলো ও বাতাসে শুকাতে দেই সেগুলোও সম্পদ। এগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ কারণ এগুলোর উৎস প্রাকৃতিক এবং মানুষের জীবনে এগুলোর চাহিদা রয়েছে।

একটি সম্পদ ব্যবহার করে ফেলার পর সেটি আবার প্রাকৃতিকভাবে পূরণ করা যায় কি না সেটি সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এর ভিত্তিতে সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-নবায়নযোগ্য সম্পদ এবং অনবায়নযোগ্য সম্পদ।

15.2 নবায়নযোগ্য সম্পদ

নবায়নযোগ্য সম্পদ হলো সেইসব সম্পদ যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে পূরণ করা যায় কিংবা মানুষের জীবদ্দশার মাঝেই আবার উৎপাদন করে ফেলা যায়। সেজন্য নবায়নযোগ্য সম্পদকে সব সময় অনবায়নযোগ্য সম্পদের টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

15.2.1 নবায়নযোগ্য সম্পদের বৈশিষ্ট্য

নবায়নযোগ্য সম্পদের প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-প্রাচুর্য, পুনরায় উৎপাদনের ক্ষমতা এবং পরিবেশে কোনো বিরূপ প্রভাব না ফেলা।

প্রাচুর্য: নবায়নযোগ্য সম্পদসমূহের প্রাচুর্য রয়েছে এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। যেমন, যতদিন সূর্য পৃথিবীকে আলোকিত করবে ততদিন আমরা সৌরশক্তি পাব, লক্ষ কোটি বছরের মধ্যেও তা শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা: নবায়নযোগ্য সম্পদ অনেক সময় পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। যেমন-কোনো গাছের ডাল ছেঁটে জ্বালানি সংগ্রহ করলে সে গাছে আবার নতুন ডালপালা গজায়। বনও পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা রাখে, বন থেকে সীমিতভাবে সম্পদ সংগ্রহ করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি আবার পূরণ হয়ে যায়। 2007 সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কারণে সুন্দরবনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে জনগণকে ভেঙে পড়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত গাছ বন থেকে সংগ্রহ থেকে বিরত রাখা হয়। ফলে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় বছরের মাঝে সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো পুনরায় আগের রূপে ফিরে এসেছিল।

পরিবেশে ন্যূনতম বিরূপ প্রভাব: নবায়নযোগ্য সম্পদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেগুলো পরিবেশের উপর খুব কম বিরূপ প্রভাব ফেলে-অনেক সময় কোনো বিরূপ প্রভাবই ফেলে না। যেমন-সূর্যের আলো, তাপ অথবা বায়ুশক্তি ব্যবহার করলে তা পরিবেশের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলে না।

15.2.2 নবায়নযোগ্য সম্পদের উদাহরণ

পৃথিবীতে নানা ধরনের নবায়নযোগ্য সম্পদ আছে, তার মধ্যে কিছু সম্পদ আমাদের শক্তি চাহিদা পূরণ করে আর কিছু সম্পদ আমাদের বস্তুগত চাহিদা পূরণ করে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নবায়নযোগ্য সম্পদের কথা নিচে উল্লেখ করা হলো: সৌরশক্তি: 

সূর্যের অভ্যন্তরে ফিউশন নামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শক্তি সৃষ্টি হয়। সূর্য থেকে নির্গত সেই সৌরশক্তি তাপ এবং আলো হিসেবে পৃথিবীতে আসে। তাপের উৎস এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌরশক্তির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তোমরা সবাই ফটোভোল্টাইক প্যানেল বা সৌর প্যানেল দিয়ে সূর্যের আলোকে সরাসরি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করতে দেখেছ। বড়ো সোলার কনসেন্ট্রেটর দিয়ে বাষ্প উৎপাদন করে সেগুলোও নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। শীতপ্রধান দেশে পানি গরম করা এবং ঘর গরম রাখার জন্যও সৌরশক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বায়ুশক্তি: প্রাচীনকাল থেকে মানুষ বায়ুশক্তি ব্যবহার করে এসেছে, কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে নদীতে পালতোলা নৌকা একটি খুবই পরিচিত দৃশ্য ছিল যেগুলো কোনো জ্বালানি বা মানুষের শ্রম ব্যবহার না করে বিপুল পরিমাণ পণ্যকে স্থানান্তর করতে পারত। বাতাসের শক্তি কাজে লাগিয়ে উইন্ড টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা যায়। ডেনমার্ক, উরুগুয়ে, চীন, লিথুয়ানিয়া, জার্মানি প্রভৃতি দেশ বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে কক্সবাজার এবং কুতুবদিয়ায় বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা শুরু হয়েছে। বায়ুশক্তি থেকে কোনো দূষিত পদার্থ পরিবেশে ছড়ায় না, এজন্য এটি পরিচ্ছন্ন শক্তি। এছাড়াও বায়ুশক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

পানিশক্তি: জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অতিকায় জলাধারের পানির চাপকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে যেটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে বড়ো ভূমিকা পালন করে। সৌর বা বায়ুশক্তির মতো অসীম সময়ব্যাপী না হলেও একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র অনেক বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।

বায়োমাস: বায়োমাস বলতে বিভিন্ন জৈব পদার্থকে বোঝায়। যেমন-হাঁস মুরগির খামারের বর্জ্য, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট, গবাদি পশুর খামারের বর্জ্য, অন্যান্য কৃষিবর্জ্য, কাঠ ইত্যাদি। এসব বর্জ্যের অনেকগুলো পচনের মাধ্যমে এবং কিছু সরাসরি ব্যবহার করে তাপ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। বায়োগ্যাস প্লান্ট ব্যবহার করে তা থেকে জ্বালানি গ্যাস এবং তার পাশাপাশি উর্বর জৈব সার পাওয়া যায় যেগুলো পরবর্তী সময়ে কৃষি জমিতে ব্যবহার করা যায়। জৈব সার পরিবেশবান্ধব, রাসায়নিক সারের মতো পরিবেশ দূষণ করে না। মানুষ এবং অন্যান্য পশুপাখি ক্রমাগত জৈব বর্জ্য উৎপাদন করে, তাই বায়োমাসকে নবায়নযোগ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বনাঞ্চন: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত কারণে নানা ধরনের বনের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ এবং জীবজগতের সকল প্রাণীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের একটি বড়ো অংশ এই বনাঞ্চল সরবরাহ করে। মানুষের প্রয়োজনের অনেক বস্তুও বন থেকে সংগ্রহ করা হয়। যথাযথ নিয়ম মেনে বনজসম্পদ সংগ্রহ করা হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে বন সেগুলো পূরণ করে ফেলে।

ভূতাপীয় শক্তি: ভূপৃষ্ঠ থেকে যত গভীরে যাওয়া যায় সেখানে তাপমাত্রা তত বেশি হতে থাকে। এই তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। এটি করার জন্য পাইপ ব্যবহার করে ভূগর্ভে পানি প্রবেশ করানো হয়, সেখানে পানি ভূগর্ভস্থ তাপের কারণে উত্তপ্ত বাষ্পে পরিণত হয়, তখন অন্য আরেকটি পাইপ দিয়ে বাষ্প বের করে এনে সেটি কাজে লাগানো হয়। যে সকল দেশে আগ্নেয়গিরি রয়েছে বা ভূপৃষ্ঠ থেকে স্বল্প গভীরতাতেই তাপ রয়েছে সেসব দেশে ভূতাপীয় শক্তি কাজে লাগানোর ভালো সুযোগ রয়েছে।

আইসল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ইতালি ইত্যাদি দেশগুলো ভূতাপীয় শক্তি কাজে লাগানোর উপযোগী। আইসল্যান্ডে তাপের চাহিদার ৭০% ভূতাপীয় শক্তি থেকে সরবরাহ করা করা হয়। ভূতাপীয় শক্তির উৎপাদনে পরিবেশ দূষণ ঘটে না, তাছাড়া এই শক্তিও প্রায় অসীম।

15.2.3 নবায়নযোগ্য সম্পদের সুবিধা ও অসুবিধা:

নবায়নযোগ্য সম্পদগুলো সাধারণত কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, এবং করলেও তা খুবই সামান্য। এর ফলে নবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে না। যেহেতু এগুলো প্রাকৃতিকভাবে বা মানুষের প্রযুক্তির সাহায্যে পুনরায় পূরণ করে ফেলা যায় তাই এই সম্পদের দীর্ঘমেয়াদি প্রাপ্যতা নিশ্চিত রয়েছে। বিভিন্ন নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করে একটিমাত্র শক্তির উৎসের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন-যেখানে সৌরশক্তি অথবা পানিশক্তি সহজে পাওয়া যায় সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজন কম অথবা অনেক ক্ষেত্রে নেই।

তবে নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তি সব সময় সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, মেঘলা দিনে অথবা রাতের বেলা সৌরশক্তি পাওয়া যায় না। এজন্য সৌরশক্তি থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করতে হয় কিন্তু বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য কার্যকর ব্যাটারির প্রযুক্তি যথেষ্ট জটিল এবং খরচ সাপেক্ষ। এ ছাড়া এখন যে অবকাঠামোগুলো রয়েছে সেগুলো মূলত অনবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কাজেই নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহারের জন্য নতুন অবকাঠামো তৈরি একটু সময়সাপেক্ষ, এবং এর ব্যবহারও কিছুটা কঠিন এমনকি অনেক সময় সেজন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হয়। নবায়নযোগ্য শক্তি অবকাঠামো বসানোর জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে বেশি, যদিও সময়ের সাথে সাথে সেই খরচ ধীরে ধীরে কমে আসবে। এছাড়া সকল ধরনের নবায়নযোগ্য সম্পদের মাঝে সমন্বয় রাখা জরুরি যেন প্রয়োজনে একটির অভাব আরেকটি পূরণ করতে পারে।

15.3 অনবায়নযোগ্য সম্পদ

অনবায়নযোগ্য সম্পদ পরিমাণে সীমিত এবং এগুলো ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে লক্ষ লক্ষ বছরে গঠিত হয়েছে। একবার ব্যবহৃত হয়ে গেলে সেগুলো মানুষের জীবদ্দশার মাঝে আর পুনরায় পূরণ করা সম্ভব হয় না। অনবায়নযোগ্য সম্পদের মাঝে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি, খনিজ পদার্থ, পারমাণবিক জ্বালানি ইত্যাদি। বিভিন্ন মূল্যবান বস্তুও অনবায়নযোগ্য সম্পদের মাঝে পড়ে।

15.3.1 অনবায়নযোগ্য সম্পদের উদাহরণ

নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনবায়নযোগ্য সম্পদের কথা বলা হলো।

জীবাশ্ম জ্বালানি: জীবাশ্ম জ্বালানি বলতে আমরা কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসকে বুঝিয়ে থাকি এবং এগুলো হলো বৈশ্বিক শক্তির প্রাথমিক উৎস। বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ লক্ষ কোটি বছর ধরে মাটি ও পাথরের নিচে চাপা পড়ে বিভিন্ন জীবাশ্ম জ্বালানিতে রূপান্তরিত হয়। এই জীবাশ্ম জ্বালানি গত কয়েক শতাব্দী থেকে শিল্পায়ন ও পরিবহণকে চালিত করেছে। আমরা যে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যাতায়াত করি সেই সিএনজি আসলে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে প্রস্তুত করা হয়। আবার যে বাস বা ট্রেনে আমরা যাতায়াত করি তা মূলত ডিজেলের চলে। যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাই তার অনেকগুলোই কয়লা দিয়ে চালানো হয়। এসবই হচ্ছে অনবায়নযোগ্য।

খনিজ এবং ধাতু: লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতু বিভিন্ন ধরনের খনিজ আকরিক থেকে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া সোনা, রুপা, প্লাটিনাম, হীরা প্রভৃতি মূল্যবান দ্রব্যও খনি থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং এগুলো অনবায়নযোগ্য। এগুলোর মজুদ সীমিত এবং একবার সংগ্রহ হয়ে গেলে তা আর পূরণ করা যায় না।

পারমাণবিক জ্বালানি: পারমাণবিক জ্বালানি, বিশেষ করে ইউরেনিয়াম পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়ামকে বিভাজন করে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করা হয়, যেগুলো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। তবে এই পারমাণবিক জ্বালানি নিষ্কাশন এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। কয়েকটি আকরিক (যেমন-পিচব্লেন্ড) থেকে ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করা হয়ে থাকে।

15.3.2. অনবায়নযোগ্য সম্পদের সুবিধা এবং অসুবিধা

অনবায়নযোগ্য সম্পদ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যায়। এই সম্পদ ব্যবহারের একটি বড়ো সুবিধা হচ্ছে এর বিশাল শক্তি ঘনত্ব, অর্থাৎ অল্প পরিমাণ সম্পদে অনেক শক্তি সঞ্চিত থাকে, এবং সেটি উৎপাদন বা পরিবহণ করা সুবিধাজনক। এছাড়া চলমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প খরচে অনবায়নযোগ্য সম্পদ উৎপাদন ও ব্যবহার করা যায়, সে কারণেই বেশির ভাগ সময়ে এগুলো ব্যবহার করা হয়।

অন্যদিকে অনবায়নযোগ্য সম্পদের নিষ্কাশন, প্রক্রিয়াকরণ এবং দহন পরিবেশের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। পরিবেশের অবক্ষয়, বায়ুদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে অনবায়নযোগ্য সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের অনেক বড়ো ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও অনবায়নযোগ্য সম্পদ সীমিত কাজেই তার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এসব সম্পদের অভাব দেখা দিতে পারে।

টেকসই উন্নয়নের জন্য নবায়নযোগ্য এবং অনবায়নযোগ্য সম্পদ উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন সম্ভব তখন নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার এবং অপারগ হলে দায়িত্বশীলভাবে অনবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদ এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব।

15.4 সম্পদ ও বর্জ্য

সম্পদ ব্যবহারের একটি বড়ো সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সেগুলো বর্জ্য উৎপাদন করে, তবে সেগুলো মূলত অনবায়নযোগ্য সম্পদ থেকে সৃষ্টি হয়। যেমন কাচবালি থেকে কাচ উৎপন্ন হয় যা থেকে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু কাচের দ্রব্য ভেঙে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি একটি অপ্রয়োজনীয় বর্জ্যে পরিণত হয়। হাইড্রোকার্বন থেকে প্লাস্টিকের বোতল এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করা হয়, কিন্তু তার ব্যবহার শেষ হয়ে গেলে তা বর্জ্যে পরিণত হয়, প্লাস্টিকের পানির বোতল এর উদাহরণ। আবার আমরা যে পুরনো কাগজ, কাপড় ইত্যাদি ফেলে দেই সেগুলোও বর্জ্য। রান্নাঘরে যে আবর্জনা তৈরি হয় সেগুলো পচনশীল, এগুলো দ্রুত ঠিকভাবে সরিয়ে না নিলে পরিবেশকে দূষিত কর।

বর্জ্য পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তবে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলে একই সাথে কম সম্পদ ব্যবহার করা যায় এবং বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে ফেলা যায়। এক্ষেত্রে তিনটি R মেনে চলা হয় (RRR)। এই RRR এর অর্থ হলো ব্যবহার কমানো (Reduce), পুনরায় ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার (Reuse) এবং পুনর্ব্যবহার উপযোগী করা (Recycle)। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করে আমরা অপচয় রোধ করতে পারি এবং ব্যবহার কমাতে পারি। মূল কাজ শেষ হওয়ার পর কাচ বা প্লাস্টিকের বোতল আমরা অন্য কাজেও ব্যবহার করতে পারি। অপরদিকে কাগজ, ভাঙা কাচ, ধাতু কিংবা প্লাস্টিকের মতো যে সকল বস্তু প্রক্রিয়াজাত করে আবার ব্যবহার করা যায় সেগুলোকে নতুন করে তৈরি করার জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার বা রিসাইকেল করা যায়।

15.5 পানি ব্যবস্থাপনা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পানি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পৃথিবীর চার ভাগের তিনভাগই সমুদ্র, তারপরেও পৃথিবীর মোট পানির এক শতাংশেরও কম আমাদের ব্যবহারোপযোগী। এই এক শতাংশ ব্যবহার উপযোগী পানির প্রায় 70% কৃষিকাজে, 20% শিল্পে এবং বাকি 10% গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হয়। পানি একটি নবায়নযোগ্য সম্পদ, কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার, অপচয় কিংবা দূষিতকরণের কারণে এটি অনবায়নযোগ্য হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে এর বিশাল চাহিদার কারণে পানি ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক।

15.5.1 ব্যবহারযোগ্য পানির ধরন

পৃথিবীর পানির 97% রয়েছে সমুদ্রে এবং মহাসমুদ্রে, এই পানি লবণাক্ত। লবণাক্ত পানির তুলনায় মিঠা পানি মাত্র 3%। এই মিঠা পানির মাত্র 1% রয়েছে ভূপৃষ্ঠে নদী, হ্রদ কিংবা জলাশয়ে। বাকিটুকু রয়েছে মাটির নিচে, গ্লেসিয়ারে কিংবা পাহাড়ের বরফ চূড়ায়। মিঠা পানির উৎস, যেমন-নদী, হ্রদ, বিভিন্ন জলাশয় এবং ভূগর্ভস্থ জলরাশিতে লবণের পরিমাণ খুব কম থাকে তাই সেগুলো মানুষের ব্যবহার ও বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয়। ভূপৃষ্ঠের নিচে সঞ্চিত ভূগর্ভস্থ পানি কৃষি এবং পানীয় জলের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। গভীর ও অগভীর কূপ, নলকূপ ইত্যাদি ভূগর্ভস্থ পানি সংগ্রহ করতে ব্যবহার করা হয়। নদী, হ্রদ এবং জলাধারের উপরিভাগের পানি সেচ, মৎস্য চাষ, পরিবহন, শিল্প প্রক্রিয়া এবং বিনোদনমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে সাগরের পানি লবণাক্ত এবং এই লবণাক্ত পানিকে ব্যবহার বা অন্যান্য ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য তা থেকে লবণ অপসারণ করা প্রয়োজন। তবে প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল।

15.5.2 বিভিন্ন ক্ষেত্র বা উদ্দেশ্যে পানির ব্যবহার

কৃষি কৃষি জমিতে সেচ, পশুপালন এবং মাছ চাষের জন্য পানি অপরিহার্য যেটি আমাদের খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করে এবং আমাদের জীবিকা অর্জনে সাহায্য করে।

ঘরোয়া ব্যবহার: পান করা, রান্নার কাজে, পরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, সুস্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য পানি অপরিহার্য।

শিল্প: শিল্পখাতে উৎপাদন প্রক্রিয়া, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি শীতলীকরণ ব্যবস্থা এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য পানির প্রচুর ব্যবহার হয়ে থাকে।

শক্তি উৎপাদন: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কিংবা পারমাণবিক চুল্লিতে শীতলীকরণ ব্যবস্থায় পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র: পানি বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র, বন্যপ্রাণির আবাসস্থল এবং পরিবেশগত কাজকর্মে সাহায্য করে, পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা নিশ্চিত করে।

15.5.3 পানির প্রাপ্যতা এবং সীমাবদ্ধতা

পৃথিবীর সব জায়গায় পানি সমানভাবে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের উপর দিয়ে শত শত নদী প্রবাহিত হয়ে গেলেও পৃথিবীতে এমন অনেক অঞ্চল আছে যেটি মরুভূমি এবং যেখানে পানির প্রাপ্যতা খুবই কম। আবার অনেক জায়গায় যথেষ্ট পানি থাকলেও ব্যবহার উপযোগী পানির পরিমাণ খুব কম। কোনো কোনো এলাকায় পানির সরবরাহ থেকে চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে সেখানে পানির ঘাটতি হয়। যখন কোনো এলাকায় পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হয় তখন সেখানে পানি সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি হয় যার ফলে সেখানকার মানুষ ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব পড়ে। সে কারণে অনেক সময় সামাজিক উত্তেজনা এমনকি রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।

কোনো স্থানে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হলে সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। তখন আগের কূপ বা টিউবওয়েল থেকে আর পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। উপকূলীয় এলাকায় অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হলে সমুদ্র থেকে লোনা পানি ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করে সেটিকে লবণাক্ত করে ফেলতে পারে, লবণাক্ত পানি বেশিরভাগ সময় সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং দ্রুত নগরায়ণ পানি সম্পদে চাপ সৃষ্টি করে, এজন্য শহরাঞ্চলে কার্যকর পানি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন খুব বেশি।

সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন, বেশি সময়ব্যাপী খরা, এবং পানিচক্রের পরিবর্তন পানির অভাবকে বাড়িয়ে তুলে পানির প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। এটি আমাদের সমাজ জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে।

15.5.4 পানি ব্যবস্থাপনা কৌশল 

টেকসইভাবে পানি ব্যবহারের জন্য কার্যকর পানি ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি সংরক্ষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা পানির অপচয় কমাতে সাহায্য করে। তার জন্য প্রয়োজন একদিকে দক্ষ সেচ ব্যবস্থা, পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি অন্যদিকে জনসচেতনতামূলক প্রচারনা। দূষিত পানিকে পরিশোধনের মাধ্যমে সেগুলো কৃষিকাজ, কলকারখানা এবং পরিবেশগত উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে বিশুদ্ধ পানির উপর চাপ কমানো যেতে পারে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করলে সেটি পানির একটি অতিরিক্ত উৎস হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে সীমিত পানি সম্পদ আছে এরকম অঞ্চলে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর।

সবশেষে বলা যায়, টেকসই পানি ব্যবহার এবং নিরাপদ পানির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পানির ধরন, ব্যবহার এবং প্রাপ্যতা বিবেচনা করে একটি কার্যকর পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা খুবই প্রয়োজন।

 

Content added By
Promotion